তথ্য পাচার কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সাথে ড্রাইভিং লাইসেন্সের চুক্তি বিআরটিএর

বছর জুড়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিআরটিএ এখন মহা অশান্তির কারণ

Samsuddin Chowdhury    |    ০২:০৭ পিএম, ২০২০-১২-৩১


বছর জুড়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিআরটিএ এখন মহা অশান্তির কারণ

সামসুদ্দীন চৌধুরীঃ টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে রশি টানাটানির কারণে সারাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্যক্রম থমকে গেছে। অভিযোগ আছে, একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে ইতোমধ্যে কয়েক দফা টেন্ডার পরিবর্তন করা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু কার্ড ছাপানোর ব্যবস্থা হলেও সার্বিকভাবে বললে থমকে গেছে বিআরটিএ অন্যতম সেবা এই কার্যক্রম। মূলত স্মার্ট কার্ড সঙ্কটের কারণে লাইসেন্স দিতে পারছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। অথচ প্রায় ২৫ লাখ আবেদন ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কাছে জমা আছে। ফলে গ্রাহক ভোগান্তি বেড়েছে চরমে। বিআরটিএ নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা বদনামের মধ্যে ২০২০ সালে নতুন করে যুক্ত হয়েছে কার্ড না থাকা।

অভিযুক্তরা বলছেন, সঙ্কট প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় চলছে। সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরও নির্ধারিত তারিখে স্মার্ট কার্ড নিতে আসলে, দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। আবার আবেদনের পর কার্ড কিংবা পরীক্ষার জন্য সময় দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত! ফলে গ্রাহক ভোগান্তির যেন শেষ নেই। শীঘ্রই সঙ্কট সমাধানের কোন পথও দেখছেন না বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

যদিও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিআরটিএ এখন মহা অশান্তির কারণ। রাজধানীর আশপাশের দুটি বিআরটিএ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব বেশি তদ্বির না থাকলে তারা এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স করার আবেদন জমা নিচ্ছে না। 

সংশ্লিষ্টরা বলছে বিআরটিএতে বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ আবেদন জমা রয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য। দরপত্র প্রক্রিয়া চলছে অনেকদিন থেকেই। সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ও তদারকিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করাই এখন বিআরটিএ মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

২০২০ সালে দরপত্র আহ্বান এবং কার্যাদেশ নিয়ে বিপাকে বিআরটিএঃ

বিআরটিএর একাধিক কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে এখন ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভয়াবহ সঙ্কট চলছে। লাইসেন্স মুদ্রণে দরপত্র আহ্বান এবং কার্যাদেশ প্রদান নিয়ে রশি টানাটানির কারণে বিপাকে পড়েছে বিআরটিএ। মূলত একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য বারবার টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর একারণেই সঙ্কটের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

২০১৯ সালের ১০ জুন লাইসেন্স কার্ডের জন্য প্রথম টেন্ডার আহ্বান করে বিআরটিএ। এতে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এরপর একই টেন্ডার নোটিসে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই, ২৮ জুলাই, আট ও ২৮ আগস্ট চারবার সংশোধনী আনা হয়। এরপর আগের টেন্ডার নোটিশ বাতিল করে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করে বিআরটিএ।

প্রশ্ন দাড়ালো টেন্ডার নিয়ে কেন এত জটিলতা। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ২০১৯ সালে প্রথম আহ্বান করা টেন্ডারে দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কিন্তু মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রাইভেট লিমিটেডকে সুবিধা দিতে টেন্ডার প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেয়া হয় এবং স্পেসিফিকেশনে পরিবর্তন আনা হয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স সর্বনিম্ন দরদাতা হতে পারেনি। টেন্ডারে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয় ফ্রান্সের সেপল সিকিউর এবং তার লোকাল এজেন্ট আইবিসিএজ প্রাইমেক্স কোম্পানি। তাদের টেন্ডার প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে ওঠেপড়ে লাগে মাদ্রাজ। তারা বিআরটিএতে দাখিল করা সেপল সিকিউর-এর টেন্ডারের কাগজপত্র সংগ্রহ করে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে। এবার প্রশ্ন আসলো সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র কিভাবে মাদ্রাজের হাতে গেল? তারপর মাদ্রাজ লিখিতভাবে সেপলের বিরুদ্ধে বিআরটিএতে কয়েকটি ঠুনকো অনিয়ম তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে লিখিত আবেদন করে। এখানে প্রশ্ন হলো যদি কাগজপত্রে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তা ধরার দায়িত্ব টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের। বাইরের একটি প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি চিহ্নিত করার এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠে। আবার অনেকে বলছে বিআরটিএর তাহলে কি করছিল?

ত্রুটির বিষয়ে বিআরটিএ আনুষ্ঠানিক সেপলের কাছে জানতে চাইলে কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করা হয়। এক পর্যায়ে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের আবেদন আমলে নিয়ে সেপলের বিরুদ্ধে কয়েক দফা তদন্ত হয়। পরিবর্তীতে তা মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই শেষে বিআরটিএ’র নির্দেশে টেন্ডার বাতিল করা হয়। অর্থাৎ সেপলের আবেদন আমলে নেয়া হয়নি। তখন সেপলের পক্ষ থেকে কয়েক দফা চিঠিতে কোন রকম কারণ ছাড়াই কেন টেন্ডার বাতিল করা হলো জানতে চাওয়া হয় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কাছে। এক পর্যায়ে বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, যে কোন প্রয়োজনে টেন্ডার বাতিলের এখতিয়ার বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের রয়েছে। এরপর আবারও একই কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্রথম বারের চেয়ে কম দর দিয়ে টেন্ডারের জন্য মনোনীত হয় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স! শুধু তাই নয় প্রতিষ্ঠানটির কাজ নিশ্চিত করা ও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে টেন্ডার নোটিস সংশোধন করে ৩৫ লাখ স্মার্ট কার্ডের স্থলে ৪০ লাখ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

মাদ্রাজ সিকিউরিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগঃ

সর্বশেষ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে কাজ পাওয়া মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে নিজ দেশ ভারতে রয়েছে বড় এক দুর্নীতি কেলেঙ্কারির প্রমাণ। ভারত, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, বাংলাদেশসহ অনেক দেশে প্রতিষ্ঠানটি অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ আছে।
২০১৫ সালে কোম্পানিটি বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে বিএমইটির ইমিগ্রেশন কার্ড বিতরণের মাধ্যমে। মাত্র পাঁচ লাখ কার্ড তারা সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে বিএমইটির- নিজেদের কার্ড ছাড়িয়ে নিতে হয়েছিল।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভারতীয় সরকারী সংস্থা ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি ২০১১-১২ অর্থবছরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং পরবর্তীতে তাদের যে কোন ধরনের এনরোলমেন্ট থেকে নিষিদ্ধ করে। তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ হলো আধার ডাটাকে তারা অন্য একটি প্রাইভেট কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিত। যা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং ব্যক্তি পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের শামিল। এই অভিযোগে মাদ্রাজ সিটিউরিটি প্রিন্টার্স আধার প্রজেক্ট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় একটি টেন্ডারে অংশ নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে কেনিয়াতে এক দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় আদালতের আাদেশে লোকাল পার্টনারসহ নয়জন পরিচালককে গ্রেফতার করা হয়। এই ফৌজদারি অপরাধের মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কেনিয়াতে আরও একটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে যা ‘কেবস ফার্টিলাইজার’ কেস হিসেবে সেদেশে বহুল প্রচলিত।

অভিযোগ আছে বিআরটিএ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করে আগের টেন্ডার বাতিল করে নতুন টেন্ডারে এমএসপি সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশে বিদেশে অভিযুক্ত মাদ্রাজের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিআরটিএসহ মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিয়েছে। তাছাড়া মাদ্রাজ টেন্ডার প্রাক্কলনের চেয়ে ৩৭ ভাগ কম মূল্যে টেন্ডারের মূল্য নির্ধারণ করেছে। গত বছরের ১০ জুন একই টেন্ডারে মাদ্রাজ সিটিউরিটি প্রিন্টার্স দরপত্র দাখিল করেছিল এক কোটি ৬৩ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ ডলারে। এই হিসেবে কার্ড প্রতি দর আসে চার দশমিক ৬৭ ডলার। পরবর্তীতে দরপত্রে প্রতিষ্ঠানটি এক কোটি ৪১ লাখ ৫৬ হাজার ৮০৫ ডলারে দরপত্র দাখিল করে। এতে কার্ড প্রতি দর আসে তিন দশমিক ৫৩ ডলার।

আজ অবসরে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ বিআরটিএর এডি আব্দুল হান্নানঃ

পাবনার গোপালপুর গ্রামের মৃত আব্দুল গফুর মিয়ার ছেলে আব্দুল হান্নান। এসএসসি পরীক্ষার সনদ অনুযায়ী ১৯৬২ সালের ১লা জানুয়ারী তিনি জন্মগ্রহন করেন। ১৯৯১ সালের ২৮ মে মোটরযান পরিদর্শক হিসেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ১৫ এপ্রিল বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) হিসেবে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। 

সরকারী চাকরি আইন ২০১৮ অনুযায়ী ৫৯ বছর পূর্ণ হওয়ায় চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছে এই সহকারী পরিচালক আব্দুল হান্নান। তবে তার এই অবসরটি সুনামের সাথে হচ্ছে না। সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদানের বছর খানের পরে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের অনুসারী হিসেবে দুর্নীতির চর্চ্চা শুরু করেন তিনি। চাকরি জীবনের ডজন খানেক দুর্নীতির মধ্যে ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বিআরটিএর মানিকগঞ্জ সার্কেলে সহকারি পরিচালক পদে কর্মরত থাকাকালে জালিয়াতি করে বিআরটিএ কেরানীগঞ্জ ইকুরিয়া অফিস থেকে ভুয়া কাগজপত্রে ১৮টি গাড়ির নিবন্ধন ও ছাড়পত্র দিয়ে গাড়িগুলো মানিকগঞ্জ সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তিনি। এই ঘটনায় গত ১৭ দিন আগে বরখাস্ত করেছে বিআরটিএ। 

আরো পড়ুন >>>>>>>>> চাকরীর শেষের ১৭ দিন আগে দুর্নীতিবাজ বিআরটিএর এডি আব্দুল হান্নান বরখাস্ত

দুনীতির সম্রাট এডি আনসারী এখন কারাগারেঃ

চোরাই গাড়ির নিবন্ধন দেওয়ার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় কারাগারে গেলেন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সহকারী পরিচালক আইয়ুব আলী আনসারী। বরিশাল বিশেষ আদালতের বিচারক মো. মোহসিনুল ইসলাম তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে কয়েকটি মামলার একাধিক তারিখে আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আইয়ুব আলী আনসারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছিলেন আদালত। 

আইয়ুব আলী আনসারী বর্তমানে বিআরটিএর ঢাকা কার্যালয়ে কর্মরত। বরিশাল, ভোলা ও ঝালকাঠিতে পরিদর্শক এবং সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত থাকাবস্থায় তার বিরুদ্ধে অগণিত দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন আবেদনকারীদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চোরাই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিতেন তিনি।

আরো পড়ুন >>>>>> বিআরটিএর দুর্নীতির সম্রাট সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনসারী পর্ব-১

আরো পড়ুন >>>>>> বিআরটিএর সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনসারী গ্রেফতার

ফিটনেস প্রদানে মোটরযান পরিদশক সংকটঃ

বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা ৫৯টি উপাদান পরীক্ষা করে ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। তবে জনবল সংকটের কারণে নিয়ম মেনে কাজটি করতে পারছেন না বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শকরা। দেশে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নেয়া গাড়ির সংখ্যা ৪৪ লাখ ৭১ হাজার (জুন ২০২০ পর্যন্ত)। এর বিপরীতে বিআরটিএতে মোটরযান পরিদর্শকের পদ ১২৫টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ১০৯ জন। এ হিসাবে প্রতি ৪১ হাজার গাড়ির বিপরীতে একজন করে মোটরযান পরিদর্শক কাজ করছেন। দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। স্বভাবতই বাড়ছে ফিটনেস সনদের চাহিদা। ২০১২-১৩ অর্থবছর সাড়ে চার লাখ ফিটনেস সনদ ইস্যু ও নবায়ন করেছিল বিআরটিএ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিআরটিএর ৫৭টি জেলা সার্কেল অফিস ও পাঁচটি মেট্রো অফিসের কার্যালয় থেকে ফিটনেস সনদ ইস্যু করা হয় সাত লাখের বেশি। গাড়ির সংখ্যা বছর বছর বাড়লেও মোটরযান পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ছে না। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সীমিত জনবল দিয়ে এত বিপুলসংখ্যক গাড়ির ফিটনেসের বিষয়গুলো দেখভাল করা অসম্ভব। জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি ফিটনেস পরীক্ষায় আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়ে আসছেন তারা।

বাজেটে গাড়ির নিবন্ধন ফি ৫০ শতাংশ বেড়েছেঃ

অর্থবছরে গাড়ির নিবন্ধন ব্যয় বাড়ানো হবে। গাড়ির ইঞ্জিনের ধারণক্ষমতা এবং গাড়ির মডেলের ধরনের ওপর নতুনভাবে অগ্রিম কর নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব বাজেট প্রস্তাবে ৫০ থেকে ৬৭ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ৬৮৮বি ধারা অনুসারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিএ) ১৯৮৪ ধারায় ব্যক্তিগত যানবাহনের মালিকদের কাছ থেকে যানবাহন নিবন্ধন বা বার্ষিক ফিটনেস নবায়নের জন্য অগ্রিম আয়কর সংগ্রহ করে থাকে। বর্তমানে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫০০ সিসির গাড়ির ক্ষেত্রে প্রতিবছর অগ্রিম কর ১৫ হাজার টাকা থাকলেও তা বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা ধার্যের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ৬৭ শতাংশ বাড়ানো হলো।

ইঞ্জিনের ক্ষমতা এক হাজার ৫০০ সিসি থেকে দুই হাজার সিসি পর্যন্ত বর্তমানে ৩০ হাজার টাকা থাকলেও তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা ধার্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ সিসির গাড়ির ক্ষেত্রে অগ্রিম কর ৫০ হাজার টাকা থাকলেও তা বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। দুই হাজার ৫০০ সিসি থেকে তিন হাজার সিসির গাড়ির ক্ষেত্রে ৭৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে অগ্রিম কর এক লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ সিসির ক্ষেত্রে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা ধার্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিন হাজার সিসির বেশি হলে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা ধার্যের প্রস্তাব করা হয়েছে।

৫৬০ কোটি টাকা নিয়েও বিআরটিএর ট্র্যাকিং সিস্টেম সেবা প্রশ্নবিদ্ধঃ

২০১২ সালে যখন ডিজিটাল নম্বর প্লেট দেওয়া শুরু করে তখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ডিজিটাল নম্বর প্লেট সম্বলিত গাড়ি চুরি হয়ে গেলে গাড়িটি ট্র্যাক করা যাবে এবং অপরাধমূলক কাজে গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছে কী না, সেটি শনাক্ত করা যাবে। তাই সব ধরণের গাড়ীর জন্য ডিজিটাল নম্বর প্লেট বাধ্যতামূলক করা হয়। এই রেট্টো-রিফ্লেক্টিভ নাম্বারপ্লেট ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগের জন্য মোটর সাইকেল ও থ্রী-হুইলারের জন্য ২ হাজার ২৬০ টাকা ও চার চাকার পরিবহনের জন্য ৪ হাজার ৬২৮ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। 

বিআরটিএ সদর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত চার বছরে বিআরটিএ ১৬ লাখ ১২ হাজার ডিজিটাল নাম্বার প্লেট ও ট্যাগ সরবরাহ করে ৫৬০ কোটি টাকা আদায় করেছে। কিন্তু ডিজিটাল নম্বর প্লেট দিয়ে যেসব সুবিধার কথা বলা হয়েছিল, সেটি গাড়ির মালিকরা পায়নি বললেই চলে। কারণ ডিজিটাল নম্বর প্লেটের ট্যাগ শনাক্ত করতে পারে, এমন চেক পোস্ট রয়েছে মাত্র ১২টি, যার সবগুলোই ঢাকায়। দেশের বানিজ্যিকর রাজধানী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য কোন জেলায় এই চেকপোস্ট নেই। এমনকি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য বিআরটিএ কাউকেই নিয়োগ দেয়নি।
২০১২ সালে ডিজিটাল এই প্লেট ও ট্যাগ তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। বিএমটিএফ-কে প্রথম ৫ বছরের জন্য প্রায় ৫৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিআরটিএ। এছাড়া পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য আরও ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধের কথা রয়েছে। তবে কতগুলো ডিজিটাল প্লেট লাগছে তার ওপর নির্ভর করে টাকার পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে।

শুধু স্টিলের শিটে ডিজিটাল নম্বর খোদাই এবং গাড়ির গ্লাসে আরএফআইডি স্টিকার লাগিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে বিআরটিএ। অথচ আনুসাঙ্গিক প্রযুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। অসন্তুষ্ট গাড়ি মালিকদের অভিযোগ, এই প্রযুক্তি থেকে টাকা ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষ জনবল না থাকায় প্রকল্পটি সফলতার মুখ দেখেনি।

মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বেকায়দায় ছিল চট্টগ্রাম বিআরটিএঃ

২০০৪ সালে তৈরীকৃত ৩৬১৬ টি সিএনজি অটোরিকশা ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। এই অটোরিকশা গুলো এখনও চলছে চট্টগ্রাম নগরীতে একই সঙ্গে এই গাড়ী গুলোর রয়েছে গতির দুর্গতি এবং দুর্গতির গতি। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশা বিআরটিএ নিবন্ধন দিয়েছেল ২০০১ সাল থেকে। ইতিমধ্যে ২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ মডেলে যে সকল অটোরিকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল এমন সাড়ে ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা ইতিপূর্বে স্ক্রাপকরণ শেষ করেছে চট্টগ্রাম বিআরটিএ। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে প্রস্তুতকৃত ৩৬১৬ টি সিএনজি অটোরিকশা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়।  দফায় দফায় ঘোষনা দিয়েও ২০২০ সালে এই গাড়ি গুলো স্ক্যাপ করে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি বিআরটিএ। এই গাড়ি গুলো নিয়ে যেমন মালিকরা ভোগান্তিতে ছিল একই ভাবে ঝুঁকি নিয়ে এই গাড়ি গুলোতে ভ্রমন করেছে যাত্রীরা।